ঢাকা ০৯:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেলে থেকে দুর্ধর্ষ জলদস্যু!

আকাশ ইসলাম
  • সময় ০৭:৪৪:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪
  • / 248

জীর্ণ পোশাক, ভারী অস্ত্র, জিপিএস ফোন – তাদের এ বেশভূষা দেখে মনে করার উপায় নেই তারা কেবল মরিয়া হয়ে দস্যুবৃত্তির পথে নেমেছে। তারা পেশায় ছিলেন সাধারণ জেলে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিলো। এখন আর কেউই তাদের কাছে নিরাপদ নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারনে জাল ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে সোমালিয়ার জেলেরা। একটা সময় ছিল, যখন সোমালিয়ার উপক‚ল ছিল জীবনের স্বপ্নের মতো সুন্দর এবং শান্ত। স্থানীয় জেলেরা প্রতিদিন ভোরবেলা নৌকা নিয়ে বের হতেন মাছ ধরতে, তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। কিন্তু এই শান্ত জীবন আজ অন্ধকারে ঢেকে গেছে।

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় উপকূলের মালিক সোমালিয়া। যেখানকার পানি ছিল আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ, এই পানিতেই বিচরণ করে টুনা, মার্লিনসহ দামি মাছেরা। এই মৎস্য সম্পদই সোমালিয়ার কাল হলো। বিদেশি মাছ শিকারিদের নজর পড়লো সেখানে। তারা আধুনিক নৌযান ও গভীরে ফেলবার মতো জাল নিয়ে সোমালিয়ার সমুদ্রসীমার মাছ চুরি করতে থাকলো।

২০০৬ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সোমালিয়ায় কোনো সক্রিয় কোস্টগার্ড না থাকায় দেশটির জলসীমায় এসে বিভিন্ন দেশের নৌযান বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে সিফুড লুট করে নিয়ে যায়।  এতে বেকার হয়ে পড়তে থাকলো সোমালিয়ার সামুদ্রিক জেলেরা। প্রায় দুই দশকের মতো সময় সোমালিয়ার সমুদ্র এলাকায় এভাবে শোষণ চালিয়েছে এসব বিদেশিরা।

সঙ্গে যোগ হয় সমুদ্রের দূষণ। বিদেশী জাহাজগুলি শুধু মাছ ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সোমালিয়ার সমুদ্রের উপক‚লে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ ফেলতে শুরু করে। উপক‚লে হানা দিতে থাকে রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজ। তারা বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে সেখানে। উপক‚লীয় অধিবাসীরা অসুস্থ হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম তাদের গায়ে অদ্ভুত দাগ দেখা দিত, তারপর শুরু হলো বমি এবং বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব। অন্যদিকে মাছ কমতে থাকে সোমালিয়ার উপকূলে।

২০০৫ সালের সুনামির পর, তাদের উপক‚ল ভরে যায় হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেলে। মানুষ তেজস্ক্রিতায় ভুগতে থাকে। ৩০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়।

সে সময়ে সোমালিয়ায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, এসব তেজস্ক্রিয় উপাদানের মধ্যে ছিলো সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি। যার বেশিরভাগই ইউরোপীয় বিভিন্ন হাসপাতাল ও কারখানাগুলো থেকে আসছিলো। ইতালিয় মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এগুলো সোমালিয়ার জলসীমায় খালাস করছিলো।

দ্বিতীয় বিপদটা আরো ভয়াবহ। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উচ্ছেদের পর সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘ নৈরাজ্যের মধ্যে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ে। জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিমারা সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়।

এরও আগে সোমালিয়ার একাংশ ছিল ইতালিয় শাসনে আরেকাংশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। তারা খুবই স্বাধীনচেতা জাতি। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা তাদের জনসংখ্যার তিন ভাগকে মেরে ফেলে। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীও সেখানে গণহত্যা চালায়।

তাছাড়া সোমালিয়ার সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদের জন্যও সেখানে নিয়ন্ত্রণ চায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি ও ফ্রান্স। নব্বই দশক থেকে একের পর এক মার্কিন আক্রমণ, সিআইয়ের গোপন অভিযান, মার্কিন মদদে ইথিওপিয়ার আগ্রাসনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে দেশটি।

এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছিলেন উপক‚লীয় এলাকায় বাস করা সোমালি জনগণ। নিজেদের সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে তাদেরকে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হতো বহিঃশত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে। এভাবে বিদেশি ট্রলারের হামলা থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯০-এর দশকে তারা প্রথম সশস্ত্র দল গঠন করে। যাদের আমরা বলছি ‘জলদস্যু’।

প্রথমে তারা স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র ফেলা ও মাছ ধরার জাহাজ ও ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও চেষ্টা চলে।

কিছু জেলে জীবনধারণের জন্য জলদস্যুতার পথ বেছে নেয়। প্রথম দিকে ছোট ছোট ট্রলার জিম্মি করার মাধ্যমে নিজেদের কৌশলগত নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলে দস্যুরা। একসময় তাদের নজর পড়ে পণ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের দিকে। এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধী গোষ্ঠীগুলিও তাদের উসকানি দিতে শুরু করে। পাশাপাশি অর্থ, অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করে। এভাবেই সোমালিয়ার জেলেরা ধীরে ধীরে ভয়ংকর জলদস্যু হয়ে ওঠে।

অতীতে এসব ট্রলার আটক করার পর দ্রæতই মুক্তিপণের অর্থ পেয়ে যেত দস্যুরা। কারণ বিদেশি এসব গোষ্ঠীগুলোও চাইত না; তারা যে আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন করেছে তা প্রকাশ্যে আসুক।

সোমালিয়ার স্থানীয় জনগণের ওপর সেখানকার সংবাদ মাধ্যম ‘ওয়ার্দার নিউজ’ এর এক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দেশটির ৭০ ভাগ জনগণ মনে করে জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার জাতীয় কৌশল। যেমনটি করেছিলেন মার্কিনিরা।

শেয়ার করুন

জেলে থেকে দুর্ধর্ষ জলদস্যু!

সময় ০৭:৪৪:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট ২০২৪

জীর্ণ পোশাক, ভারী অস্ত্র, জিপিএস ফোন – তাদের এ বেশভূষা দেখে মনে করার উপায় নেই তারা কেবল মরিয়া হয়ে দস্যুবৃত্তির পথে নেমেছে। তারা পেশায় ছিলেন সাধারণ জেলে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিলো। এখন আর কেউই তাদের কাছে নিরাপদ নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারনে জাল ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে সোমালিয়ার জেলেরা। একটা সময় ছিল, যখন সোমালিয়ার উপক‚ল ছিল জীবনের স্বপ্নের মতো সুন্দর এবং শান্ত। স্থানীয় জেলেরা প্রতিদিন ভোরবেলা নৌকা নিয়ে বের হতেন মাছ ধরতে, তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। কিন্তু এই শান্ত জীবন আজ অন্ধকারে ঢেকে গেছে।

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় উপকূলের মালিক সোমালিয়া। যেখানকার পানি ছিল আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ, এই পানিতেই বিচরণ করে টুনা, মার্লিনসহ দামি মাছেরা। এই মৎস্য সম্পদই সোমালিয়ার কাল হলো। বিদেশি মাছ শিকারিদের নজর পড়লো সেখানে। তারা আধুনিক নৌযান ও গভীরে ফেলবার মতো জাল নিয়ে সোমালিয়ার সমুদ্রসীমার মাছ চুরি করতে থাকলো।

২০০৬ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সোমালিয়ায় কোনো সক্রিয় কোস্টগার্ড না থাকায় দেশটির জলসীমায় এসে বিভিন্ন দেশের নৌযান বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে সিফুড লুট করে নিয়ে যায়।  এতে বেকার হয়ে পড়তে থাকলো সোমালিয়ার সামুদ্রিক জেলেরা। প্রায় দুই দশকের মতো সময় সোমালিয়ার সমুদ্র এলাকায় এভাবে শোষণ চালিয়েছে এসব বিদেশিরা।

সঙ্গে যোগ হয় সমুদ্রের দূষণ। বিদেশী জাহাজগুলি শুধু মাছ ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সোমালিয়ার সমুদ্রের উপক‚লে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ ফেলতে শুরু করে। উপক‚লে হানা দিতে থাকে রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজ। তারা বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে সেখানে। উপক‚লীয় অধিবাসীরা অসুস্থ হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম তাদের গায়ে অদ্ভুত দাগ দেখা দিত, তারপর শুরু হলো বমি এবং বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব। অন্যদিকে মাছ কমতে থাকে সোমালিয়ার উপকূলে।

২০০৫ সালের সুনামির পর, তাদের উপক‚ল ভরে যায় হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেলে। মানুষ তেজস্ক্রিতায় ভুগতে থাকে। ৩০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়।

সে সময়ে সোমালিয়ায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, এসব তেজস্ক্রিয় উপাদানের মধ্যে ছিলো সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি। যার বেশিরভাগই ইউরোপীয় বিভিন্ন হাসপাতাল ও কারখানাগুলো থেকে আসছিলো। ইতালিয় মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এগুলো সোমালিয়ার জলসীমায় খালাস করছিলো।

দ্বিতীয় বিপদটা আরো ভয়াবহ। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উচ্ছেদের পর সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘ নৈরাজ্যের মধ্যে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ে। জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিমারা সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়।

এরও আগে সোমালিয়ার একাংশ ছিল ইতালিয় শাসনে আরেকাংশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। তারা খুবই স্বাধীনচেতা জাতি। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা তাদের জনসংখ্যার তিন ভাগকে মেরে ফেলে। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীও সেখানে গণহত্যা চালায়।

তাছাড়া সোমালিয়ার সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদের জন্যও সেখানে নিয়ন্ত্রণ চায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি ও ফ্রান্স। নব্বই দশক থেকে একের পর এক মার্কিন আক্রমণ, সিআইয়ের গোপন অভিযান, মার্কিন মদদে ইথিওপিয়ার আগ্রাসনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে দেশটি।

এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছিলেন উপক‚লীয় এলাকায় বাস করা সোমালি জনগণ। নিজেদের সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে তাদেরকে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হতো বহিঃশত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে। এভাবে বিদেশি ট্রলারের হামলা থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯০-এর দশকে তারা প্রথম সশস্ত্র দল গঠন করে। যাদের আমরা বলছি ‘জলদস্যু’।

প্রথমে তারা স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র ফেলা ও মাছ ধরার জাহাজ ও ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও চেষ্টা চলে।

কিছু জেলে জীবনধারণের জন্য জলদস্যুতার পথ বেছে নেয়। প্রথম দিকে ছোট ছোট ট্রলার জিম্মি করার মাধ্যমে নিজেদের কৌশলগত নেটওয়ার্ক বাড়িয়ে তোলে দস্যুরা। একসময় তাদের নজর পড়ে পণ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের দিকে। এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধী গোষ্ঠীগুলিও তাদের উসকানি দিতে শুরু করে। পাশাপাশি অর্থ, অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করে। এভাবেই সোমালিয়ার জেলেরা ধীরে ধীরে ভয়ংকর জলদস্যু হয়ে ওঠে।

অতীতে এসব ট্রলার আটক করার পর দ্রæতই মুক্তিপণের অর্থ পেয়ে যেত দস্যুরা। কারণ বিদেশি এসব গোষ্ঠীগুলোও চাইত না; তারা যে আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন করেছে তা প্রকাশ্যে আসুক।

সোমালিয়ার স্থানীয় জনগণের ওপর সেখানকার সংবাদ মাধ্যম ‘ওয়ার্দার নিউজ’ এর এক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দেশটির ৭০ ভাগ জনগণ মনে করে জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার জাতীয় কৌশল। যেমনটি করেছিলেন মার্কিনিরা।