জাল সনদে শতকোটির মালিক নিউমার্কেট আ’লীগ নেতা
![](https://banglaaffairs.com/storage/2024/09/Png-250-200.png)
- সময় ০২:১৩:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / 641
জাল সনদ, নকল বই, ফুটপাতে চাঁদাবাজি- এমন এক গুচ্ছ অভিযোগ রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা হাজী বিপ্লব সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। তার উত্থানটাও বেশ নাটকীয়তায় ভরপুর।
অভিযোগ রয়েছে, ভাগ্য অন্বেষণে প্রায় দুই যুগ আগে মামার হাত ধরে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় আসেন এই বিপ্লব সরকার। ঢাকায় এসে নীলক্ষেতের একটি ফটোকপির দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানেই তার হাতে খড়ি হয় জাল সনদ ও পাইরেট বই বিক্রির। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
জাল সনদের টাকার প্রভাবে সক্রিয় হন রাজনীতিতে। ধীরে ধীরে বাগিয়ে নেন নিউমার্কেট ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। তারপর সব সিন্ডিকেট বাদ দিয়ে নিজের নামেই শুরু করেন জাল সনদ সিন্ডিকেট; যা ‘ বিপ্লব সিন্ডিকেট’ নামে বহুল পরিচিত। তখন স্থানীয় সজল, মাহবুব ও আলমগীরের মত অস্ত্রধারীরাও যুক্ত হয় এ সিন্ডিকেটে।
অভিযোগ রয়েছে- জাল সনদ ও নকল বই বিক্রি এবং নিউমার্কেট নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করে হাজার কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে বিপ্লব সরকার ও তাঁর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির এসব অর্থ পাচার করে দুবাইয়ে হোটেল এবং ভারতে বাড়ি করেছেন, নিউমার্কেটে সাতটি দোকান করেছেন বলেও অভিযোগ উঠছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে সব দোকান বন্ধ করে আত্নগোপনে চলে যায় এই নেতা। সম্প্রতি বিএনপির স্থানীয় এক নেতার আশীর্বাদে তা আবার খুলেছে। শুরু করে দিয়েছে আবারও সেই পুরনো জাল সার্টিফিকেট ও নকল বইয়ের ব্যবসা।
২০১২ সাল থেকে জাল সনদ ও নকল বইয়ের পাশাপাশি বিপ্লবের হাতে চলে আসে নিউমার্কেট ও সায়েন্সল্যাবের ফুটপাত নিয়ন্ত্রের সুযোগ। রাজধানীর নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাব ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকা ঘিরে ফুটপাত ও সড়কে ১২শ থেকে ১৩শ দোকান রয়েছে। এছাড়া রাস্তার ডিভাইডার ও বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আরও ২০০ দোকান করেছিলেন এই বিপ্লব সরকার। মোট ১৫০০ দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলত এ সিন্ডিকেট। এছাড়া দোকান নিয়ে বসার জন্য এককালীন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দিতে হতো বিপ্লবকে।
হকারদের তথ্য মতে, ১৫’শ দোকান থেকে গড়ে ৬০০ টাকা করে চাঁদা উঠলে মাসে প্রায় তিন কোটি টাকা ওঠে। আর ঈদে এই চাঁদার পরিমাণ বেড়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা হয়ে যায়। এ টাকা তিনটি ভাগে ভাগ করা হত স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাসহ রাজনৈতিক কর্মীরা পায় একটি ভাগ। দ্বিতীয় ভাগ পায় পুলিশ। তৃতীয়টি চলে যায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কাছে।
প্রতিটি দোকান থেকে ৬শ’ টাকার মধ্যে পুলিশ নিতো ১শ’ টাকা, লাইনম্যানদের ৫০ টাকা, স্থানীয় নেতারা পায় ১শ’ টাকা এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা পায় ১শ’ টাকা করে। চাঁদার টাকা তুলতে পেশাদার লাইনম্যানও নিয়োগ করেছিলেন বিপ্লব সরকার।
সূত্র মতে, সায়েন্সল্যাবের বায়তুল মামুর মসজিদ মার্কেটের সামনে থেকে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের ফুটপাত পর্যন্ত একটি লাইন। এভাবে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার থেকে কাদের আর্কেড শেরওয়ানি মার্কেট হয়ে ওরিয়েন্টাল লাটিমী শপিংমল পর্যন্ত একটি। লাটিমী মল থেকে জাহান ম্যানশন শপিংমল, গোল্ডেন গেন শপিং সেন্টার, মাহমুদ ম্যানশন ও পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত একটি লাইন। এই ফুটপাতগুলোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ঢাকা কলেজের নর্থ ব্লকের ছাত্রলীগ নেতারা।
এছাড়া গ্লোব শপিং সেন্টার থেকে বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট, নেহার ভবন শপিং সেন্টার, নূরজাহান সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন রয়েছে। নূরজাহান থেকে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ফুটপাত পর্যন্ত আরেকটি লাইন। ধানমন্ডি হকার্সের দক্ষিণ পাশের শুরু থেকে নূরানী মার্কেট, মিনি মার্কেট, এয়াকুব সুপার মার্কেট, কাজী ম্যানশন, শাহানুর ম্যানশন, রিজেন্সি প্লাজা হয়ে ইস্টার্ন মল্লিকা পর্যন্ত একটি লাইন। ইস্টার্ন মল্লিকার উল্টো পাশ থেকে নিউমার্কেটের দিকে আসতে গ্রিন স্মরণিকা, সুবাস্তু এ্যারোমা সেন্টার শপিং মল, ইসমাইল ম্যানশন, গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন, চাঁদনি চক মার্কেট পর্যন্ত একটি লাইন। চাঁদনি চক থেকে বলাকা সিনেমা হল পর্যন্ত একটি, বলাকা থেকে নীলক্ষেত হয়ে নিউমার্কেট থানার আগ পর্যন্ত একটি লাইন রয়েছে।
নীলক্ষেত মোড় থেকে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট পর্যন্ত একটি, চন্দ্রিমা থেকে ঢাকা কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হয়ে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত একটি এবং চন্দ্রিমা থেকে বিশ্বাস বিল্ডার্স হয়ে শাহনেওয়াজ হল পর্যন্ত আরেকটি লাইন রয়েছে।
এছাড়া কাঁচাবাজারের জন্য তাঁদের আলাদা চাঁদার ফর্দও রেয়েছে। ফুটপাতগুলোর লাইনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ছিলেন, সাত্তার মোল্লা, বিপ্লব সরকারের নিজের ফুফাতো ভাই শাহীন, সেলিম আমিনুল, মামুনসহ আরো বেশ কয়েকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউমার্কেটের একজন ব্যবসায়ী বলেন, বিল্পব সরকারের সাথে এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রক হিসাবে আলোচিত নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের ১৮নং ওয়ার্ডের সাবেক নেতা ইব্রাহিম হোসেন ইবু; ফুটপাতের ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাঁরা। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্যেও চাঁদাবাজদের তালিকায় তার নাম রয়েছে। ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব সরকার এবং লিটন ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হোতা। তাদের ইশারাতেই চলে ফুটপাতের সব কার্যক্রম। তাছাড়া নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে বিপ্লবের হাতে। এদের প্রত্যেকেই একসময় সামান্য আয়ের মানুষ ছিলেন। ফুটপাতের কল্যাণে এখন তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং আলিশান জীবন-যাপন।
এছাড়া ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় নেতা সাত্তার মোল্লা, উজ্জ্বল, ছৈয়া, মামুন, বিল্লাল, বাচ্চু, রাহাত, ইসমাইল, আকবর, আমিনুল, সেলিম ও শাহিন এরাই ছিল বিগত সরকারের আমলে।
নিউমার্কেটের এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চাঁদা যাই আসুক ইবু প্রতি মাসের শুরুতে ১ কোটি টাকা ক্যাশ দিতেন বিপ্লব সরকারকে। ইবু মাদকের সাথেও জড়িত। যদিও এর পুরো মদদই দিয়েছে বিপ্লব। কি ছিল এই বিপ্লব, মাদক ও সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে বই মার্কেটে, পাইরেসি ব্যবসা এবং ফুটপাতের চাঁদাবাজি করে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক। দুবাইয়ে রেষ্টুরেন্ট খুলেছেন ‘হাজী মোহাম্মদ বিপ্লব সরকার’। বউ ও শ্বশুরের নামে কিনেছেন ফরিদপুরে কয়েকশো কোটি টাকার জায়গা সম্পত্তি।
এক সময় বলাকা সিনেমা হলের সামনে টিকিট বিক্রি ও ফুটপাতে দোকানদারি করা বিপ্লব আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বদলে ফেলেন তার জীবনযাত্রা। হয়েছেন প্রায় কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক।
তিনি আরও বলেন, বিল্পবের গাড়ি কতগুলো কি ভাবে আসল এত টাকা, কত টাকা খরচ করেন তিনি কোরবানির গরু কিনতে এসব খোঁজ খবর করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
অভিযোগের বিষয়ে বিপ্লব সরকারের বক্তব্য নিতে তাকে ফোন করে ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।