জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই সব প্রস্তুতি ইসির

- সময় ১০:৪৪:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
- / 13
চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। জামায়াত চায় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন। অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আগে সংস্কার, এরপর স্থানীয় সরকার এবং এর পরই জাতীয় নির্বাচনের দাবি করছে। কোনো কোনো সময় আগে গণপরিষদ নির্বাচনের কথাও বলছে নতুন এ রাজনৈতিক দল। তবে সব জল্পনা-কল্পনা এবং নানা কৌতূহল আড়ালে রেখে জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমাদের সামগ্রিক ফোকাস হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। সেজন্য জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এমন কোনো ইভেন্ট আসা ঠিক হবে না, যেটা জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করে।
ইসি সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত ডিসেম্বর অথবা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে নিচ্ছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া, সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ নির্বাচন-পূর্ব নিয়মিত কাজগুলো চলমান রয়েছে। ব্যালটসহ নির্বাচনী অন্যান্য সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে মঙ্গলবার সরকারি মুদ্রণ সংস্থা বিজি প্রেসের সঙ্গে বৈঠকে বসছে নির্বাচন কমিশন। জুলাই মাসে নির্বাচনী রোডম্যাপ (কর্মপরিকল্পনা) ঘোষণারও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইসি মনে করছে, জুনের মধ্যে সংস্কার প্রক্রিয়া ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়া একটি রূপ পাবে।
এরপর সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা সহজ হবে। একই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপেরও চিন্তা-ভাবনা রয়েছে সংস্থাটির।
সূত্র আরও জানায়, যে সময়ের ঘোষণা আসুক, ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরেই সব ধরনের প্রস্তুতি সেরে নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তুতির কোনো কমতি রাখা হবে না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে খানিকটা শঙ্কা থাকলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরোপুরি সক্রিয় অবস্থা ফিরে আসবে বলেও আশাবাদী ইসি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে মনযোগ দেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেই লক্ষ্যে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে তিন মাস মেয়াদে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এরই মধ্যে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে প্রধান বিচারপতিসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থার প্রধানরাও পদত্যাগ করেন। এর অংশ হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি শূন্য হয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন কমিশন নিয়োগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ায় বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। অবশেষে আউয়াল কমিশন পদত্যাগের প্রায় আড়াই মাস পর ২১ নভেম্বর এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন কমিশনকে নিয়োগ দেয় সরকার।
এদিকে, নিয়োগ পেয়েই ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণসহ নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কমিশন। যদিও নির্বাচন কবে হবে, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন, আগে জাতীয় নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, আগে গণপরিষদ নাকি জাতীয় নির্বাচন—এসব ইস্যুর এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। তবে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং সরকারের ভেতরে নানা মত থাকলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছোটখাটো সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে এবং বড় পরিসরে সংস্কার হলে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে ভোট হতে পারে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। কোনোভাবেই তারা ডিসেম্বরের পরে নির্বাচনে রাজি নয়। নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন দলটির নেতারা। আরেক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াত চায় আগে সংস্কার এবং স্থানীয় নির্বাচন। এরপর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চান দলটির নেতারা। আর এনসিপি ও নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি নতুন দল আগে সংস্কার, এরপর স্থানীয়, এরপর গণপরিষদ এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন চায়। নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত মত রয়েছে সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার একজন উপদেষ্টা বলেছেন, জনগণ চায় এ সরকার আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থাকুক। এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো উপসংহারে আসতে পারছেন না অনেকে। তবে কমিশন সব কিছু ছাপিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ও রোডম্যাপকেই আমলে নিচ্ছে।
নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন নিয়ে দলগুলোতে নানা মতভেদ থাকলেও এই মুহূর্তে শুধু জাতীয় নির্বাচন নিয়েই ভাবছে কমিশন। সাড়ে ১২ কোটির বেশি ভোটারের জন্য ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ধরনের ফরম, প্রচারপত্র, আচরণবিধি, ম্যানুয়ালসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ছাপাতে হবে। এতে হাজার টনের মতো কাগজের প্রয়োজন পড়তে পারে। বড় এই নির্বাচনী যজ্ঞ নিয়ে মঙ্গলবার বিজি প্রেসের সঙ্গে বৈঠক করবে ইসি। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এ সভায় নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত কাগজপত্রের ক্রয়, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ; মুদ্রণ কার্যক্রম শুরুর সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ; জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট পেপার মুদ্রণের প্রস্তুতি; স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত) নির্বাচনের ব্যালট পেপার মুদ্রণ পরিকল্পনা; সরবরাহ না হওয়া সামগ্রীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
ইসির কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচনের বড় প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে শেষ করতে হয় এবং বাকিগুলো তপশিলের পর। আপাতত আগের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রস্তুতির পাশাপাশি নির্বাচনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। তবে সে সংলাপের দিনক্ষণ এখনো ঠিক না হলেও জুন-জুলাই নাগাদ হতে পারে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনের তপশিল-পূর্ব প্রস্তুতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটার তালিকা। প্রচলিত আইন মেনে গত ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা (২০২৪ সালের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে) প্রকাশ করা হয়েছে। চলতি বছরের হালনাগাদ কার্যক্রমও চলছে। এর অংশ হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ভোটার নিবন্ধনের কাজও শেষ পর্যায়ে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমে ৬০ লাখের বেশি ভোটারযোগ্য নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২১ লাখের বেশি মৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী জুন নাগাদ ভোটার তালিকার হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ করা যাবে বলে আশা করছে ইসি।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়েও কাজ করছে কমিশন। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে একটি আদমশুমারি হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু আসন নিয়ে জটিলতাও আছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে অন্তত ৪ শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে ইসিতে। তবে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনে একটি ধারায় ছাপার ভুল থাকায় ইসি বর্তমান আইনে সীমানায় বড় পরিবর্তন আনতে পারবে না। তাই তারা ছাপার ভুলটি ঠিক করে আইনে সংশোধনী আনার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এটি অনুমোদন পায়নি। অনুমদোন পেলে খুব শিগগির এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসবে কমিশন। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারের তরফ থেকে আইন সংশোধন হয়ে এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা না হলে বিদ্যমান সীমানায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে কমিশন।
সূত্র জানায়, আরপিও, আচরণ বিধিমালা, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালাসহ কয়েকটি বিধিমালা সংশোধনের জন্য নিজেদের মতো করে উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালার খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে ইসির সংশ্লিষ্ট কমিটি। এটি অনুমোদনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সভায় তোলা হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ প্রস্তাবিত আচরণ বিধিমালায় যুক্ত করা হয়েছে বলে ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ইসি। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মাত্র একটি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। তবে যেভাবেই হোক জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নতুন দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় ইসি। পাশাপাশি ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা সংশোধন এবং প্রয়োজনীয় কেনাকাটার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। প্রবাসীদের ভোট প্রদানসহ নানা ইস্যুতে কাজ চলছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণে যত দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, ততই মঙ্গল। সেজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদী।