চীনপন্থী ভাসানী, ভারত বিরোধিতায় মিলেনি স্বীকৃতি
- সময় ১২:২১:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
- / 67
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের মাত্র ৩৫ বছর বয়সে যিনি কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন তার নাম ভারতরত্ন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। পণ্ডিত মাওলানা আজাদ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশীধার মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া হয়নি। মূলত ভারতের বিরোধিতার কারণেই তিনি তেমনভাবে সম্মানিত হতে পারেননি। এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে সঙ্গীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রাচীনতম। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যে দলটির পথপরিক্রমা শুরু হয়েছিল, আজ তা জাতির পিতা শেখ মুজিবময় হয়ে গেছে।
মাওলানা ভাসানী প্রথম আট বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। দলের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তরুণ সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে তিনি হন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। মাত্র ৮ বছরের মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠিত দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করেন ভাসানী।
শুরুতে নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পথে পা বাড়ায়।
সে সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব ছিল। ভাসানী বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায়, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের দিকে ঝুঁকেছিলেন, যেখানে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। এই আন্তর্জাতিক প্রভাবও ভাসানী ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির একটি কারণ।
পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি, কাগমারী সম্মেলনে। এ নিয়ে ওই সময় সোহরাওয়ার্দী ইস্তফা দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক ভাঙন এড়ানো সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু তা দলের ঐক্যকে দুর্বল করে দেয়। এক পর্যায়ে এই আদর্শিক কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সভাপতির পদ ত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী।
ওই সময় আওয়ামী লীগের ভাসানী অংশের উদ্যোগে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৪-২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী।
মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আদর্শগত কিছু মতভেদ ছিল। ভাসানী ছিলেন বামপন্থী, তিনি সবসময় শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস করতেন। চীনাপন্থী ছিলেন মাওলানা ভাসানী এমনটাই ইতিহাস সাক্ষী দেয়।
অন্যদিকে, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মধ্যপন্থী রাজনীতি করতেন এবং তারা প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই পরিবর্তন আনতে চাইতেন। এই আদর্শগত পার্থক্য একসময় তীব্র আকার ধারণ করে, যার ফলে ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আওয়ামী লীগ তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দলটির কার্যক্রম নিয়ে কিছু মতানৈক্য ছিল। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আপোষহীন ছিলেন।
ভাসানী মনে করতেন, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই মতানৈক্য থেকে দলের অভ্যন্তরে বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং ভাসানী দল থেকে সরে আসেন।
মাওলানা ভাসানী ছিলেন একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নেতা, যার নেতৃত্বের ধরন অনেক সময় দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সংঘর্ষের সৃষ্টি করত। তার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কখনো কখনো একনায়কতান্ত্রিক আচরণ প্রকাশ পেত, যা দলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করত। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের আচরণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভাসানী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দলীয় কৌশল ও কর্মসূচি নিয়ে ভিন্নমত ছিল। ভাসানী সবসময় গণ আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন, যেখানে দলের অন্য নেতারা সংসদীয় পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চাইতেন। এই কৌশলগত ভিন্নমত দলীয় কাজে বিরোধের সৃষ্টি করে।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসার পরে তিনি নতুন দল গঠন করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার এই বিচ্ছেদ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে, এক ঐতিহাসিক দিন। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে লাখো মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে রওনা হয়েছিলেন। সেই ফারাক্কা লং মার্চের প্রভাব তখনকার সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
৪৮ বছর পরও ফারাক্কা লং মার্চের গুরুত্ব এখনো ফিকে হয়নি। বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পানির সংকটের কারণে, এই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা আবারো আলোচনায় এসেছে।
ফারাক্কা বাঁধ, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলায় গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত, এর প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পানি সংকট ও নদীশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষি, মৎস্যসম্পদ এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ফারাক্কা লং মার্চের সময় মাওলানা ভাসানী এই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ একত্রিত হয়েছিল এবং ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেছিল।
মাওলানা ভাসানী রাজশাহী থেকে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে এই অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। এই পদযাত্রা ১৭ মে বিকালে ভারতীয় সীমান্তের কাছে কানসাটে গিয়ে শেষ হয়।
সাধারণভাবে, ভারত থেকে বাংলাদেশে ৫৩টি নদী প্রবেশ করেছে। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে মাত্র একটি নদী, কুলিক নদী। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে উৎপত্তি হয়ে এটি ভারতে প্রবেশ করেছে।
এই ৫৪ নদীর মধ্যে মাত্র একটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে, আর তা হলো গঙ্গা নদী। তবে সেই নদীর পানির প্রবাহ হিসাব করা হয় ফারাক্কা পয়েন্টে। ফারাক্কা পয়েন্টের আগেই অনেক পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পায় না বলে বরাবরই অভিযোগ।
মূলত কলকাতা বন্দরে ব্রিটিশ সরকারের জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধা সৃষ্টি করতেই এই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কারণ হুগলী-ভাগীরথী নদী ক্রমশ নাব্যতা হারাচ্ছিল। ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়; কীভাবে গঙ্গার জলের এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগীরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।
তৎকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এই বাঁধের বিরোধিতা করা হয়েছিল। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এই বাঁধ তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকেও এর বিরোধিতা করা হয়েছিল।
১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ৭ হাজার ৩৫০ ফুট লম্বা। এটি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত হয়। বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে।
ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধের উপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় সড়ক ও রেলপথ, যা কেবল উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকেই নয়, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশকে বাকি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে।
মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সন্তোষে তার পরিবার, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মুরিদান, ভক্ত, রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।