চিকেন নেক নিয়ে কেন এতো উদ্বিগ্ন ভারত !

- সময় ০৪:০৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / 43
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী দাবি করেছেন, সম্প্রতি পাকিস্তানের কতিপয় সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী শিলিগুঁড়ি করিডোর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা। যা নিয়ে চটেছে ভারত সরকার।
কিন্তু চিকেন নেক নামে পরিচিত এই শিলিগুঁড়ি করিডোর নিয়ে ভারত সরকার এতোটা উদ্বিগ্ন থাকে কেন ?
করিডোরটি দৈর্ঘ্যে ৬০ কিলোমিটার। প্রস্থে মাত্র ২০ কিলোমিটার। সংকীর্ণ এ করিডোরটিই হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের সংযোগস্থল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত শিলিগুড়ি করিডোরের দক্ষিণ পাশে বাংলাদেশ। উত্তরে নেপাল, ভুটান ও চীন। শুধু চার দেশ নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে দেশটির অন্যান্য এলাকাকেও সংযুক্ত করেছে শিলিগুড়ি করিডোর। সরু এ করিডোরই এখন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে ভারত ও চীনের মধ্যকার বিবাদ। এ বিবাদ তীব্রতা পেলেই দুর্গম উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা কাঠামো নিয়ে বাড়তি উদ্বেগে ভুগতে দেখা যায় ভারতকে। শুধু সংযোগ এলাকা নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসেবে এলাকাটিকে বিবেচনা করে ভারত। অঞ্চলটিকে এখন দেখা হচ্ছে ভারতের নিরাপত্তা ব্যারাক ‘একিলিস হিল’ হিসেবে।
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান সীমান্ত দিয়ে তিন দিকে ঘেরা করিডোরটি থেকে চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন তিব্বতের চুম্বি ভ্যালির দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা সামরিক বাহিনী এই পথ ধরে সামনে এগিয়ে এলেই পশ্চিমবঙ্গের একাংশসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভারত থেকে পুরোপুরি সংযোগহীন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে ভুটান থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভারত।

শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের মধ্যে প্রথম উদ্বেগ দেখা যায় ১৯৬২ সালে। চীন ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ অঞ্চলটির নিরাপত্তা কৌশলগত গুরুত্বকে প্রথমবারের মতো সামনে নিয়ে আসে। পাকিস্তানের অংশ হওয়ায় ওই সময় পূর্ব বাংলা থেকেও করিডোরটি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগেছে ভারত। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ আশঙ্কা দূর হলেও এ এলাকায় চীনকে নিয়ে ভারতের আশঙ্কা সবসময়ই কমবেশি কাজ করেছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মোট ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে নিজের বলে দাবি করছে চীন। বিশেষ করে অরুণাচল রাজ্যকে বরাবরই তিব্বতের অংশ হিসেবে দেখিয়ে এসেছে দেশটি। বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশসংলগড়ব কিছু এলাকায় চীন একের পর এক সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে বলে বারবার অভিযোগ তুলছে ভারত। এসব এলাকায় চীনা সৈন্যদের উপস্থিতি শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে ভারতের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
এ বিষয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভাষ্য হলো, ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে কোনো কারণে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে চীনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু‘ হবে শিলিগুড়ি করিডোর। দেশটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রমাণও মিলেছে। তিব্বতে শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি এলাকায় নিজ সীমান্তের মধ্যে একের পর এক সড়ক ও এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করছে চীন।
এগুলো নির্মাণ হলে সংঘাতের মুহূর্তে শিলিগুড়ি করিডোরের দিকে দ্রুত সৈন্য পাঠানো চীনের জন্য সহজ হয়ে উঠবে। এছাড়া চীন নিজ সীমান্ত এলাকায় আর্টিলারি, মিসাইল ও অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অস্ত্র মোতায়েন করলে যুদ্ধকালে এলাকাটি দিয়ে রসদ পরিবহনও ভারতের জন্য এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠবে।
আবার শিলিগুড়ি করিডোর এলাকাটি হিমালয়ের কোলঘেঁষা হলেও এর প্রাকৃতিক সুরক্ষা তেমন একটা জোরালো নয়। সরু এ এলাকায় প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণও অনেক কঠিন। সব মিলিয়ে এলাকাটির প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা ভারতের জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তা উদ্বেগের পাশাপাশি ভারতের প্রশাসনিক আশঙ্কারও বড় একটি জায়গা হয়ে উঠেছে শিলিগুড়ি করিডোর। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদকেই সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা হয়।
আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোর কোনো কোনোটির সঙ্গে ভারতীয় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় বর্মিদের সঙ্গেই মিল পাওয়া যায় বেশি। ভূ-রাজনীতির ভারতীয় পর্যবেক্ষকরাও শিলিগুড়ি করিডোরকে আখ্যা দেন ‘প্রকৃতির রাজনৈতিক-ভৌগোলিক পরিহাস’ হিসেবে।
এছাড়া এলাকাটিকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ অনেক হুমকিও মোকাবেলা করতে হয়েছে ভারতকে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) ও ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএন) মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো শিলিগুড়ি করিডোর ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে ভারতের বেশ কয়েকটি বাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। চীন সীমান্তসংলগ্ন অংশে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ইন্দো-তিবেতান বর্ডার পুলিশ। ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)।

বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত প্রহরায় রয়েছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। ভারতীয় সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলস ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পুলিশের সদস্যরা নিয়মিতভাবেই এলাকাটিতে টহল দেন।
এছাড়া, বাংলাদেশের অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতাগ্রণের পর থেকেই দুইদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে ভিন্নতা আসে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক বিষয়গুলো ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূসের এই কৌশলগত পদক্ষেপের ফলে মোদী প্রশাসন বাংলাদেশের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
সামরিক সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ড. ইউনূসের এই মহাপরিকল্পনা ভারতের কিছু দুর্বল স্থানে আঘাত করেছে, যা মোদী সরকারের উদ্বেগের মূল কারণ। ফলে, ভারতের বর্তমান তৎপরতা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চক্রান্তের পেছনে ড. ইউনূসের কৌশলগত পদক্ষেপ এবং তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।