চাঁদের বুকে মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে নোকিয়া-ইনটুইটিভ মেশিনস

- সময় ০৯:৩৪:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / 25
একসময় যা ছিল নিছক কল্পবিজ্ঞান, সেটিই এবার বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। চাঁদের বুকে প্রথমবারের মতো মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য নোকিয়া ও ইনটুইটিভ মেশিনস চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে। নোকিয়ার ‘লুনার সারফেস কমিউনিকেশন সিস্টেম’ ইনটুইটিভ মেশিনসের আইএম-২ মিশনের অংশ হিসেবে চাঁদে পাঠানো হচ্ছে।
এই প্রযুক্তি আইএম-২ মিশন ল্যান্ডার ‘অ্যাথেনা’-তে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় রয়েছে। মিশনের লক্ষ্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণ করে রোভার ও ‘হপার’ মোতায়েন করা এবং চন্দ্র কক্ষপথে একটি যোগাযোগ উপগ্রহ স্থাপন করা।
নোকিয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য চাঁদের বুকে ফোরজি/এলটিই নেটওয়ার্ক স্থাপন করা। এতদিন মহাকাশযানগুলোর মধ্যে যোগাযোগের জন্য সাধারণত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতো। তবে নাসার ভবিষ্যৎ আর্টেমিস কর্মসূচির জন্য আরও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন, যেখানে নোকিয়ার এই ৪জি নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নোকিয়া বেল ল্যাবস সলিউশনস রিসার্চের প্রেসিডেন্ট থিয়েরি ক্লেইন বলেন, “আমরা প্রমাণ করতে চাই যে সেলুলার প্রযুক্তি চাঁদ ও মঙ্গলের মতো অভিযানের জন্য নির্ভরযোগ্য, উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রদান করতে পারে।”
‘লুনার সারফেস কমিউনিকেশন সিস্টেম’ অ্যাথেনার কার্বন-কোম্পোজিট প্যানেলে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা মহাকাশের কঠোর পরিবেশ সহ্য করতে থার্মাল প্রোটেকশন সিস্টেম দ্বারা সুরক্ষিত। ল্যান্ডারের সৌর প্যানেল থেকে এটি বিদ্যুৎ পাবে এবং অ্যাথেনার অ্যান্টেনার মাধ্যমে সংকেত আদান-প্রদান করবে।
এছাড়া, চন্দ্রযানের মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে দুটি অতিরিক্ত যোগাযোগ মডিউল সংযুক্ত করা হয়েছে। ইনটুইটিভ মেশিনসের তৈরি ‘মাইক্রো-নোভা হপার’ চাঁদের চিরস্থায়ী ছায়াচ্ছন্ন গহ্বর অনুসন্ধান করে পানি বরফের সন্ধান করবে। অন্যদিকে, ‘মোবাইল অটোনোমাস প্রসপেক্টিং প্ল্যাটফর্ম রোভার’ চাঁদের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র তৈরি ও পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করবে।
অবতরণের পরপরই এই যানগুলো নোকিয়ার ফোরজি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভিডিও স্ট্রিমিং, টেলিমেট্রি পাঠানো এবং পৃথিবীতে তথ্য প্রেরণ করতে পারবে।
এই মিশনের কার্যক্ষমতা স্বল্পস্থায়ী হতে পারে। চন্দ্ররাত্রির তীব্র ঠাণ্ডার কারণে রোভার ও হপার কয়েকদিনের মধ্যেই বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে, নোকিয়া ও ইনটুইটিভ মেশিনস একে ভবিষ্যৎ অভিযানের পরীক্ষামূলক ধাপ হিসেবে দেখছে।
নোকিয়া ভবিষ্যতে আর্টেমিস বেসের জন্য আরও বিস্তৃত ফোরজি (৪জি) এবং ফাইভজি (৫জি) নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এছাড়া, অ্যাক্সিয়ম স্পেসের তৈরি মহাকাশচারীদের স্পেসস্যুটেও সেলুলার যোগাযোগ সংযুক্ত করার কাজ চলছে।
চাঁদে মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের বিষয়ে কিছু বিজ্ঞানী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এলটিই প্রযুক্তির ফ্রিকোয়েন্সি (৭০০ মেগাহার্জ থেকে ২.৬ গিগাহার্জ) আংশিকভাবে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য সংরক্ষিত ব্যান্ডের সঙ্গে মিলে যায়। এতে চাঁদ থেকে আসা সংকেত মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরির স্পেকট্রাম ম্যানেজার হার্ভে লিস্টজ বলেন, “চাঁদে পূর্ণাঙ্গ সেল নেটওয়ার্ক থাকলে তা রাতের আকাশে অতিরিক্ত সংকেত সৃষ্টি করতে পারে, যা টেলিস্কোপের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সমস্যা তৈরি করবে।”
এছাড়া, আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের নিয়ম অনুসারে চাঁদে ফোরজি নেটওয়ার্ক পরিচালনার জন্য নতুন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড নির্ধারণের প্রয়োজন হবে। আপাতত নোকিয়া আইএম-২ মিশনের জন্য বিশেষ অনুমোদন পেয়েছে, তবে স্থায়ী নেটওয়ার্কের জন্য নতুন ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারণ করতে হবে।
আইএম-২ মিশন চাঁদের গহ্বরে পানির অস্তিত্ব শনাক্ত করা, পৃষ্ঠের ছবি ও পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ এবং ভবিষ্যৎ অভিযানের জন্য প্রযুক্তিগত পরীক্ষা চালানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেবে।
নোকিয়া জানায়, “যদি কোনো সাধারণ স্মার্টফোন মহাকাশ ভ্রমণ ও চাঁদের প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে, তবে সেটি এই নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়ে ব্যবহার করা সম্ভব হবে—তবে এর জন্য বিশেষ ‘লুনার সিম কার্ড’ প্রয়োজন হবে।”
নোকিয়া ও ইনটুইটিভ মেশিনস মনে করছে, আইএম-২ মিশন সফল হলে চাঁদে আরও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে এই প্রযুক্তি চাঁদে স্থায়ী মানব উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি চন্দ্র অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখবে।