কার স্বার্থে মেঘনা আলমকে আটক! | Bangla Affairs
০২:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কার স্বার্থে মেঘনা আলমকে আটক!

নিউজ ডেস্ক
  • সময় ১০:৫৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
  • / 23

অভিনেত্রী মেঘনা আলম

মামলা ও অভিযোগ ছাড়াই অভিনেত্রী এবং মডেল মেঘনা আলমকে কার স্বার্থে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পাস করা এই আইনটিকে বরাবরাই নিবর্তনমূলক হিসাবে আখ্যা দিয়ে আসছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এবং আইন বিশেষজ্ঞরা। সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের বিরোধিতা করা ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার সেই আইনই রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করায় সমালোচনা আরো জোরালো হচ্ছে।

বুধবার (৯ এপ্রিল) রাতে মেঘনা আলমকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার বাসার দরজা ভেঙে আটক করা হয়। ভাটারা থানার পুলিশ সঙ্গে থাকলেও মেঘনার বাসায় অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বাসার বাইরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে পরিস্থিতি জানাতে ফেসবুকে লাইভ শুরু করেছিলেন মেঘনা। সেখানে অপহরণের অভিযোগ তুলেন তিনি। ফেসবুক লাইভে দেখা যায় আতঙ্কিত মেঘনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এক পর্যায়ে তিনি ‘আমি আইনজীবীসহ থানায় আসবো’ বলার পরও তার বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

পরবর্তীতে মেঘনা আলমের সেই ফেইসবুক লাইভ আর তার প্রোফাইলে পাওয়া যায়নি। তবে সেই লাইভটি ডাউনলোড করে অনেকেই নিজেদের প্রোফাইল থেকে আপলোড দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাতে তাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট। মেঘনার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ছিল না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি শুক্রবার ফেসবুকে একটি ব্যাখ্যা দেয়। তাতে দাবি করা হয়, মেঘনা আলমকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয়।

পুলিশের দাবি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।

তবে মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ করার অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে যে এ সংক্রান্ত কোনো মামলা এখনও দায়ের হয়নি, সেটা জানা গেছে খোদ পুলিশের কাছ থেকেই।

ডিএমপি উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. তালেবুর রহমানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার (মেঘনা আলম) বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তাকে কী কারণে আমরা আটক করে ৩০ দিনের ডিটেনশন দিয়েছি তা তো আমাদের বিবৃতিতে বলেছি। এর বাইরে কোনো তথ্য আমার কাছে নাই।

মেঘনা আলমের বসুন্ধরার বাসা ভাটারা থানা এলাকায়। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের থানায় তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আটক করে ৩০ দিনের ডিটেনশন দেয়া হয়েছে। মামলা থাকলে তো আর ডিটেনশন দেয়ার দরকার হতো না।

মডেল মেঘলার সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূত
মডেল মেঘলার সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূত

মেঘনা আটকে ‘সৌদি’ সংশ্লিষ্টতা?

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় সৌদি দূতবাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তার অভিযোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ মেঘনাকে আটক করেছে। ওই কর্মকর্তা এরইমধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। মেঘনা আলমও তার ফেসবুক লাইভে তার এই পরিস্থিতির জন্য ‘সৌদি রাষ্ট্রদূত দায়ী’ বলে দাবি করেছেন।

তবে এ বিষয়ে পুলিশ বা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকায় অবস্থিত সৌদি দূতাবাস থেকেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য দেয়া হয়নি।

ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সরকারের বিরুদ্ধে ‘সৌদি গোলামী’ এর অভিযোগ এনেছেন। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি মেঘনা আলমকে যে কায়দায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গুম বিষয়ক কমিশনের সদস্য নূর খানও। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের বন্ধুর মনোতুষ্টির জন্য সরকার এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করলো।

তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, সেই বিদেশি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক হোক না কেন তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে আটক করে ডিটেনশন দিয়েছে। এটা কার স্বার্থে করা হয়েছে তা দেখা দরকার।

নূর খান বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলেও আমরা এই আইনের কোনো প্রয়োগ দেখিনি। কিন্তু এই সরকার তা করলো। এটা একদমই জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যায়। সরকার হয়তো কোনো কারণে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চায়। নাগরিকদের ভয় দেখাতে চায়।

অভিনেত্রী মেঘনা আলম ২০২০ সালের মিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী। পুলিশ তার সহযোগী পরিচয়ে ব্যবসায়ী মো. দেওয়ান সমির (৫৮) নামে একজনকে আটক করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে শনিবার।

৫০ বছর আগের নিবর্তনমূলক আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন

১৯৭৪ সালে পাস হওয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। এই আইনটি প্রায় দুই দশক পর প্রয়োগ করা হলো বলে জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, আমার জানামতে বিগত ১৭-১৮ বছরে এই আইনটি প্রয়োগ হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে যে কালাকানুন ব্যবহার করা হয়নি, সেই আইন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োগ করে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করেছে।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশন এই আইনটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। আর সরকার তা প্রয়োগ করছে। এরচেয়ে বৈপরীত্য আর কী হতে পারে!

কোনো মামলা ও অভিযোগ ছাড়া মেঘনা আলমকে বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় তার বাসার দরজা ভেঙে তুলে আনা হয়। পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ম্যাজিষ্ট্রেট বসিয়ে তাকে ৩০ দিনের ডিটেনশন দেয়া হলো কোন আইনে? এটাতো আইন সাপোর্ট করে না। আর উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুনির্দিষ্ট গ্রাউন্ড ছাড়া এই আইনটি প্রয়োগ করা যাবে না, বলেন তিনি।

“এখানে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন করা হয়েছে”, অভিযোগ ব্যারিস্টার বড়ূয়ার।

অভিনেত্রী মেঘনা আলম
অভিনেত্রী মেঘনা আলম

তিনি বলেন, সেখানে কোনো নাগরিককে সুনির্দিষ্ট মামলা ও অভিযোগ ছাড়া আটক না করার কথা বলা হয়েছে। আর এই সময়ে ১৯৭৪ সালের নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ করা হলো। তাহলে নাগরিকদের অধিকার কেথায় যাবে? অবিলম্বে মেঘলা আলমকে মুক্তি দেওয়ার এবং আইনটিও বাতিলের দাবি জানিয়েছেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

মেঘনা আলমকে নিবর্তনমূলক এই আইনে আটাকাদেশ দেয়া ঠিক হয়েছে কী না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর জজ আদালতের চিফ পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, আমি তো সেটা বলতে পারবো না। আমি তো সরকারের ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। আমার কাজ তো সরকারের আদেশ কার্যকর করা।

তিনি জানান, ওই আইনে আটটি কারণে কোনো নাগরিককে সরকার ডিটেনশন দিতে পারে তার অপরাধমূলক কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য। এরমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট, দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান, দেশের আর্থিক ক্ষতি, এগুলো আছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই আটকাদেশ দিয়েছে। আর সেটা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে।

‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ প্রয়োগ করে সরকার কোনো ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে করা এই আইনটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা থাকলেও পরবর্তীতে কোনো সরকারই তা বাতিল করেনি।

পাকিস্তানে নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো বলে জানান আইন বিশ্লেষকরা। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সঙ্গে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, তার বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগও থাকতো, তাহলেও পুলিশকে দিনের বেলায় যেতে হতো। কিন্তু আমরা দেখলাম সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে তাকে দরজা ভেঙে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় ডিটেনশন দেওয়া হলো। আর তাকে ডিটেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইনের বিধান অনুসরণ করা হয়নি। তার আইনজীবীর সাথে তাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এটাতো আইনের চরম লঙ্ঘন। আর এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়নি।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন

কার স্বার্থে মেঘনা আলমকে আটক!

সময় ১০:৫৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

মামলা ও অভিযোগ ছাড়াই অভিনেত্রী এবং মডেল মেঘনা আলমকে কার স্বার্থে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেওয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পাস করা এই আইনটিকে বরাবরাই নিবর্তনমূলক হিসাবে আখ্যা দিয়ে আসছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এবং আইন বিশেষজ্ঞরা। সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের বিরোধিতা করা ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার সেই আইনই রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করায় সমালোচনা আরো জোরালো হচ্ছে।

বুধবার (৯ এপ্রিল) রাতে মেঘনা আলমকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার বাসার দরজা ভেঙে আটক করা হয়। ভাটারা থানার পুলিশ সঙ্গে থাকলেও মেঘনার বাসায় অভিযানে নেতৃত্ব দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বাসার বাইরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে পরিস্থিতি জানাতে ফেসবুকে লাইভ শুরু করেছিলেন মেঘনা। সেখানে অপহরণের অভিযোগ তুলেন তিনি। ফেসবুক লাইভে দেখা যায় আতঙ্কিত মেঘনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এক পর্যায়ে তিনি ‘আমি আইনজীবীসহ থানায় আসবো’ বলার পরও তার বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

পরবর্তীতে মেঘনা আলমের সেই ফেইসবুক লাইভ আর তার প্রোফাইলে পাওয়া যায়নি। তবে সেই লাইভটি ডাউনলোড করে অনেকেই নিজেদের প্রোফাইল থেকে আপলোড দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাতে তাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট। মেঘনার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ছিল না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি শুক্রবার ফেসবুকে একটি ব্যাখ্যা দেয়। তাতে দাবি করা হয়, মেঘনা আলমকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয়।

পুলিশের দাবি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।

তবে মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ করার অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে যে এ সংক্রান্ত কোনো মামলা এখনও দায়ের হয়নি, সেটা জানা গেছে খোদ পুলিশের কাছ থেকেই।

ডিএমপি উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. তালেবুর রহমানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার (মেঘনা আলম) বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তাকে কী কারণে আমরা আটক করে ৩০ দিনের ডিটেনশন দিয়েছি তা তো আমাদের বিবৃতিতে বলেছি। এর বাইরে কোনো তথ্য আমার কাছে নাই।

মেঘনা আলমের বসুন্ধরার বাসা ভাটারা থানা এলাকায়। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের থানায় তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আটক করে ৩০ দিনের ডিটেনশন দেয়া হয়েছে। মামলা থাকলে তো আর ডিটেনশন দেয়ার দরকার হতো না।

মডেল মেঘলার সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূত
মডেল মেঘলার সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূত

মেঘনা আটকে ‘সৌদি’ সংশ্লিষ্টতা?

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় সৌদি দূতবাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তার অভিযোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ মেঘনাকে আটক করেছে। ওই কর্মকর্তা এরইমধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। মেঘনা আলমও তার ফেসবুক লাইভে তার এই পরিস্থিতির জন্য ‘সৌদি রাষ্ট্রদূত দায়ী’ বলে দাবি করেছেন।

তবে এ বিষয়ে পুলিশ বা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকায় অবস্থিত সৌদি দূতাবাস থেকেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য দেয়া হয়নি।

ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সরকারের বিরুদ্ধে ‘সৌদি গোলামী’ এর অভিযোগ এনেছেন। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি মেঘনা আলমকে যে কায়দায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গুম বিষয়ক কমিশনের সদস্য নূর খানও। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের বন্ধুর মনোতুষ্টির জন্য সরকার এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করলো।

তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, সেই বিদেশি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক হোক না কেন তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে আটক করে ডিটেনশন দিয়েছে। এটা কার স্বার্থে করা হয়েছে তা দেখা দরকার।

নূর খান বলেন, ফ্যাসিস্ট আমলেও আমরা এই আইনের কোনো প্রয়োগ দেখিনি। কিন্তু এই সরকার তা করলো। এটা একদমই জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যায়। সরকার হয়তো কোনো কারণে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চায়। নাগরিকদের ভয় দেখাতে চায়।

অভিনেত্রী মেঘনা আলম ২০২০ সালের মিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী। পুলিশ তার সহযোগী পরিচয়ে ব্যবসায়ী মো. দেওয়ান সমির (৫৮) নামে একজনকে আটক করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে শনিবার।

৫০ বছর আগের নিবর্তনমূলক আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন

১৯৭৪ সালে পাস হওয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। এই আইনটি প্রায় দুই দশক পর প্রয়োগ করা হলো বলে জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, আমার জানামতে বিগত ১৭-১৮ বছরে এই আইনটি প্রয়োগ হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে যে কালাকানুন ব্যবহার করা হয়নি, সেই আইন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োগ করে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করেছে।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বর্তমান সংবিধান সংস্কার কমিশন এই আইনটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। আর সরকার তা প্রয়োগ করছে। এরচেয়ে বৈপরীত্য আর কী হতে পারে!

কোনো মামলা ও অভিযোগ ছাড়া মেঘনা আলমকে বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় তার বাসার দরজা ভেঙে তুলে আনা হয়। পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ম্যাজিষ্ট্রেট বসিয়ে তাকে ৩০ দিনের ডিটেনশন দেয়া হলো কোন আইনে? এটাতো আইন সাপোর্ট করে না। আর উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুনির্দিষ্ট গ্রাউন্ড ছাড়া এই আইনটি প্রয়োগ করা যাবে না, বলেন তিনি।

“এখানে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন করা হয়েছে”, অভিযোগ ব্যারিস্টার বড়ূয়ার।

অভিনেত্রী মেঘনা আলম
অভিনেত্রী মেঘনা আলম

তিনি বলেন, সেখানে কোনো নাগরিককে সুনির্দিষ্ট মামলা ও অভিযোগ ছাড়া আটক না করার কথা বলা হয়েছে। আর এই সময়ে ১৯৭৪ সালের নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ করা হলো। তাহলে নাগরিকদের অধিকার কেথায় যাবে? অবিলম্বে মেঘলা আলমকে মুক্তি দেওয়ার এবং আইনটিও বাতিলের দাবি জানিয়েছেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

মেঘনা আলমকে নিবর্তনমূলক এই আইনে আটাকাদেশ দেয়া ঠিক হয়েছে কী না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর জজ আদালতের চিফ পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, আমি তো সেটা বলতে পারবো না। আমি তো সরকারের ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। আমার কাজ তো সরকারের আদেশ কার্যকর করা।

তিনি জানান, ওই আইনে আটটি কারণে কোনো নাগরিককে সরকার ডিটেনশন দিতে পারে তার অপরাধমূলক কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য। এরমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট, দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান, দেশের আর্থিক ক্ষতি, এগুলো আছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই আটকাদেশ দিয়েছে। আর সেটা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে।

‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ প্রয়োগ করে সরকার কোনো ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে করা এই আইনটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা থাকলেও পরবর্তীতে কোনো সরকারই তা বাতিল করেনি।

পাকিস্তানে নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো বলে জানান আইন বিশ্লেষকরা। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সঙ্গে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, তার বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগও থাকতো, তাহলেও পুলিশকে দিনের বেলায় যেতে হতো। কিন্তু আমরা দেখলাম সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে তাকে দরজা ভেঙে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় ডিটেনশন দেওয়া হলো। আর তাকে ডিটেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইনের বিধান অনুসরণ করা হয়নি। তার আইনজীবীর সাথে তাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এটাতো আইনের চরম লঙ্ঘন। আর এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়নি।

সূত্র: ডয়চে ভেলে