ওয়ান ইলেভেন নাকি অন্যকিছু!
- সময় ১২:৫৩:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫
- / 83
আজ ১১ জানুয়ারি শনিবার। ২০০৭ সালে আজকের তারিখে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। শনিবার অথবা বৃহস্পতিবার; যাই হোক না কেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে ১১ জানুয়ারি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দিনটি ওয়ান-ইলেভেন নামে সমধিক পরিচিত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের এ দিনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৭ সালের এদিন বিকেলে জরুরি অবস্থা জারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়।
এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু থেকেই সমালোচিত হতে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভুয়া ভোটার তালিকা সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে।
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কিছু দিন পর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে উপদেষ্টারা একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন্।
এ অবস্থায় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
এক পর্যায়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অন্তরায় হতে পারে এমন নানা অনিয়মের আশঙ্কা ব্যক্ত করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
এ পরিস্থিতিতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ সব আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন।
তিনিই এক অনুষ্ঠানে ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে ওয়ান-ইলেভেন বা এক এগারো(১/১১) নামে আখ্যায়িত করেন।
জরুরি অবস্থা জারির পর রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এ সরকারের সময় গ্রেফতার হন।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। এ বছরই ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করে বিশেষ কারাগারে নেওয়া হয়।
এই সময় দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে। মাইনাস-টু ফর্মুলা তখন ছিলো একটি বহুল আলোচিত বিষয়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হলেও বিভিন্নভাবে আন্দোলন গড়ে ওঠে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়।
এক পর্যায়ে আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে ঘরোয়া রাজনীতিরও অনুমতি দেয়।
এর পর ধীরে ধীরে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও মুক্তি পান।
প্রায় দুই বছর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে।
সেই থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত একটানা ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। এরপর একে একে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনকে ব্যবহার করার, এমনকি দিনের ভোট রাতে দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সর্ববেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থটার দিকে এগুতে থাকে আওয়ামী লীগ। যার ফলে ৫ আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে শেখ হাসিনার পতন হয়। তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে ৫ আগস্টেই ভারত চলে যান। এখনো তিনি সেখানেই আছেন।
এদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার দাবি ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ২০২৫ সালে এসে সেটি এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। বেগম জিয়া এখন লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি আছেন। তাঁর বড় ছেলে ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও যুক্তরাজ্যেই আছেন। লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সঙ্গ দিচ্ছেন তার আপনজনরা। সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর দেখভালের দায়িত্বে আছেন দুই পুত্রবধূ। তিন নাতনিও বেশিরভাগ সময় দাদির সঙ্গেই কাটাচ্ছেন। মায়ের জন্য বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে যাচ্ছেন তারেক রহমান। পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্যে বেশ উৎফুল্লই আছেন তিনি।
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়াও ৭ জানুয়ারি বিদেশ গেলেন চিকিৎসা নিতে। কাকতালীয়ভাবে এক বছর আগে ৭ জানুয়ারিতেই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তারা দুজনের কেউই এখন বাংলাদেশে নেই। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুই নেত্রী (খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনা)কে মাইনাস করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও দুইজনই রাজনীতি করে গেছেন। এখন ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ এর প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ নির্বাচনে কি অপেক্ষা করছে, সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশিরা।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমানে অন্তর্বতীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সংস্কার কার্যক্রমের পর নির্বাচনী রোডম্যাপের পথে আগানোর কথা বললেও বর্তমান সরকারের ওপর চাপ ধরে রেখেছে বিএনপি। তবে কি আরেকটি ওয়ান ইলেভেন নাকি অন্যকিছু? এই অন্যকিছু বলতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় কোনো শক্তির উত্থান ঘটবে কিনা, সেটাই দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো জাতি।