আওয়ামী লীগ: তৃণমূলে লুটেরা-হাইব্রিড আতংক কাটেনি!
- সময় ০৪:২৯:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
- / 1075
টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্ট গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় তিনমাস হয়ে যাচ্ছে , এখনো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সঠিক দিক নিদের্শনা না পেয়ে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে আতংকও কাজ করছে। সরকারের পট পরিবর্তনের পর আবারও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হলে ত্যাগীরা কি আগের মতোই অবমূল্যায়িত থাকবেন কিনা?
বাংলা অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে আলাপকালে দেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগসহ একাধিক অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে এখনো সেই পুরোনো আতংকই বিরাজ করছে। বিরোধী দলের রাজনীতি করার সুযোগ যদি আসে তখন দেখা যাবে, পুরোনো পরিবারতন্ত্র এবং হাইব্রিড লুটেরা শ্রেণীর লোকজনই দলের নেতৃত্ব দিবে। তৃণমূল আগের মতোই অবমূল্যায়িত থাকবে। তাই এখনো তৃণমূল আওয়ামী লীগে এখনো হাইব্রিড আতংক কাটেনি। তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, নতুন করে আওয়ামী লীগ ফিরবে হাইব্রিড এবং লুটেরামুক্ত হয়েই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেন, আমাদের অস্বীকার করার সুযোগ নেই, আওয়ামী লীগের মতো বৃহত্তম একটি দলে অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ফলে দলকে বিতর্কিত করা হয়েছে সময়ে-অসময়ে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের আওয়ামী লীগ হবে পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি আদর্শকে সামনে রেখে আগামীর আওয়ামী লীগ হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের আশা পূরণের মূখপাত্র। যেখানে চিরস্থায়ীভাবে লুটেরা এবং হাইব্রিডদের বিদায় করা হবে। জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণই হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল ভিত্তি। যেখানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে কাজ করবে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে বাংলা অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল বলেন, বিদেশী একটি গণমাধ্যমে আমার যে সাক্ষাতকারটি প্রকাশ হয়েছে, সেখানে মিসকোট করা হয়েছে। আমি বলেছিলাম, পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মাঠে নামবে। তবে সেখানে আমি ২ সপ্তাহ থেকে ১ মাসের কথা সুনিদির্ষ্ট করে কিছু বলি নাই। তারপরও তারা লিখেছে। প্রয়োজনে আমাদের তো নামতেই হবে। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এবারের আওয়ামী লীগ হবে পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকেই সামনে রেখে রাজনীতি করা হবে। আত্ন সমালোচনা, দেশের মানুষের কল্যাণকেই প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি করবে আওয়ামী লীগ। সেখানে তৃণমূলই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তি। তাই তৃণমূলের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ দেখছেন না নাদেল।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতি যিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে অবমূল্যায়িত তিনি বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেন, আমরা রাজনীতি করি গণমানুষের জন্য। কিন্তু গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে। আমলা, ব্যবসায়ীদের বেশি মূল্যায়ণ করা হয়েছে। তবু নিজের অবস্থান থেকে আমি প্রতিবাদ করে দেশের মাটিতে অবস্থান জানান দিয়েছি। ভবিষ্যতেও দেবো, আমাদের মতো নেতাদের মূল্যায়ণ দল করবে কি; করবে না, সেসব নিয়ে এখন ভাবছি না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাই আমাদের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা। এর বাইরে আমরা কারো কমান্ড মানতে রাজি নই। এক্ষেত্রে অবশ্যই আওয়ামী লীগ কিভাবে পুর্নগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামবে সেটা সময়ই বলে দিবে। আমরা সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি। তবে হাইব্রিড আতংক তৃণমূলে রয়েছে বলেও স্বীকার করেন চট্টগ্রামের ওই নেতা।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক আরেকজন সভাপতিও একই সুরে বলেছেন, তৃণমূলের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা নির্বাচন না করতে পারার খেসারতই দিতে হচ্ছে দলটিকে। দলের সভানেত্রীকে ঘিরে রেখেছিল অশুভ একটি সিন্ডিকেট। আশা করছি, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বরূপে ফিরে আসবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলেও দলের নেতা নির্বাচনে একটা গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় আনাটা জরুরি।
জেলা পর্যায়ের একজন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেন, ‘আমরা কিসের জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবো? খুব সহজভাবে পারিবারিকভাবে যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত তাই এটা ছাড়াও সম্ভব না। কিন্তু দুঃখ লাগে; যখন পার্টি ক্ষমতায় ছিল, তখনো আমাদের মূল্যায়ণ করা হয়নি। ভবিষ্যতে কি হবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি সেই পুরোনো হাইব্রিড -লুটেরাদের নেতৃত্বে চলে, তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দেয়া ভালো।
একই সুরে কথা বলেছেন, হাওর অঞ্চলের মেধাবী তরুণ একজন আওয়ামী লীগ নেতা। তার দাবি, ঐতিহ্যবাহী দলটিকে গত দেড় দশকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার পাশাপাশি, দলের মধ্যে উপ দল তৈরি করা এবং প্রভাবশালী নেতাদের আস্থাভাজন না হলে পদ-পদবী পাওয়া তো দূরের কথা, কথা বলারও সুযোগ ছিল না। এখন দলের দুঃসময়ে তারা বিদেশে চলে গেছেন। নিজেরা নিরাপদে আছেন। কিন্তু দলের তৃণমূলের হাহাকার তারা শুনতে পান না। ভবিষ্যতে যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাইব্রিড এবং লুটেরাদের বাদ দেয়া না হয়; তাহলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই মুখ ফিরিয়ে নিবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেন, দেশে অন্তবর্তকালীন সরকার চলছে। আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে নিজ দলে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। দেশের তরুণ সমাজের মনের ভাষা বুঝতে পারেন, এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ক্লিন ইমেজের নেতাদের দিয়েই দল পুর্নগঠন করতে হবে আগে। সেক্ষেত্রে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেই খুঁজে বের করতে হবে, কারা প্রকৃত আওয়ামী লীগের আদর্শিক নেতাকর্মী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলামকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ পুর্নগঠনের পরামর্শও দেন ড. নাজমুল আহসান ।
তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে আদর্শ ও চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন, সেটি বঙ্গবন্ধুও ধরে রাখতে পারেননি। কালের পরিক্রমায় শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাই করেননি। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উত্তরাধিকারের বলয় থেকে আওয়ামী লীগ এরপর আর কখনোই বের হতে পারেনি। ক্ষমতচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন পতন আমাকে মোটেও হতবাক করেনি। কারণ তিনি শেষ মুহুর্তে এসে নিজেকে ‘ওয়ান্ডার লেডি’ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার একক সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত এবং শেষ সিদ্ধান্ত। দলের মধ্যেই গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না বলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহত্যবাহী দলটিকে আজ এমন করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে বলে মনে করেন প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।