অনড় অবস্থানে নির্বাচন কমিশন
শাপলা প্রতীক না দিলে কী করবে এনসিপি?

- সর্বশেষ আপডেট ০৭:১২:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর ২০২৫
- / 37
রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। প্রতীক চূড়ান্ত হলে দলটিকে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতীক ইস্যুতেই দুটি ভিন্ন অবস্থানে অনড় এনসিপি ও নির্বাচন কমিশন।
দলের প্রতীক হিসেবে শুরু থেকেই শাপলা চেয়ে আসছে এনসিপি।
তবে শাপলা রাজনৈতিক দলের জন্য তৈরি করা প্রতীকের তালিকাতেই নেই বলে জানাচ্ছে ইসি।
শাপলার বদলে গেজেটকৃত ৫০টি প্রতীকের থেকে যে কোনো একটিকে বাছাই করতে এনসিপিকে চিঠিও দিয়েছে কমিশন। তালিকা থেকে প্রতীক বাছাই করতে এনসিপিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সময়ও বেধে দিয়েছিল তারা।
তবে, এনসিপি বলছে তাদের পছন্দের শাপলা প্রতীক না দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীকের অন্য কোনোটিই নেবে না তারা।
শুধু তাই নয়, একই সাথে তারা নির্বাচন কমিশনের সাথে আর কোনো ধরনের যোগাযোগও না রাখার পক্ষে দলটি।
দলটির কোনো কোনো নেতা অবশ্য এটিও বলেছেন যে তারা শাপলা ছাড়া অন্য কোনো মার্কা দিলে নির্বাচনেও অংশ নেবে না।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ইসি যদি শাপলা প্রতীক না দিয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে তাহলে এই কমিশনের যে কোনো কার্যক্রমে আমাদের অনাস্থা থাকবে।’
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রতীক তালিকার যে নতুন গেজেট করেছে সেখানে শাপলা না থাকায় এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নাই।
সোমবার বাংলাদেশের কোনো কোনো গণমাধ্যমে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়া হচ্ছে এমন খবরও প্রকাশ করা হয়।
তবে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নতুন প্রতীক তালিকার গেজেটে যেহেতু শাপলা নাই, সে কারণে এনসিপির শাপলা প্রতীক পাওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে।’
গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ১১৫টি প্রতীক বরাদ্দ রেখে গেজেটে প্রকাশ করে। সেখানে শাপলা প্রতীক এই গেজেট তালিকায় রাখা হয়নি।
নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা বলছেন, এনসিপি যদি শেষ পর্যন্ত শাপলা বাদে অন্য কোনো প্রতীক না নিতে চায় সেটি নতুন করে সংকটও তৈরি করতে পারে।
এমনকি প্রতীক নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে এনসিপির নিবন্ধন পাওয়ার বিষয়টি আটকে থাকতে পারে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এনসিপি কেন শাপলায় অনড়?
জাতীয় নাগরিক পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যখন ইসিতে আবেদন করেছিল তখন প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল চেয়েছিল।
এর কয়েকদিন পরে আবার আরেকটি চিঠি দিয়ে দেয়। ওই সংশোধিত চিঠিতে শাপলা, লাল শাপলা অথবা সাদা শাপলা থেকে যেকোনো একটি প্রতীক চায় এনসিপি।
গত বেশ কয়েক মাস ধরেই এনসিপি নেতাকর্মীদের অনেকে শাপলা প্রতীকের দাবিতে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে একাধিকবার দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকও করেছে দলটি।
তবে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইসি গত ৩০শে সেপ্টেম্বর এনসিপিকে যে চিঠি পাঠায়, সেই চিঠিতে বলা হয়, ৭ই অক্টোবরের মধ্যে ইসির তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীক থেকে পছন্দ যে কোনো একটি প্রতীক নেওয়ার জন্য।
একই সাথে ওই চিঠিতে জানানো হয় দলটির প্রথম পছন্দ ‘শাপলা’ বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার তালিকায় নেই, তাই এটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
৫০টি মার্কার মধ্যে আলমিরা, খাট, উটপাখি, ঘুড়ি, কাপ-পিরিচ, চশমা, দালান, বেগুন, চার্জার লাইট, কম্পিউটার, জগ, জাহাজ, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মার্কা রয়েছে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও আইন সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মুসা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকালে তারা নির্বাচন কমিশনকে ইমেইলের মাধ্যমে চিঠির জবাব দিয়েছেন। এনসিপি ইসিকে জানিয়েছে, শাপলার বাইরে অন্য প্রতীক তারা গ্রহণ করবে না।
দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিক চিঠির সঙ্গে শাপলা প্রতীকের সাত ধরনের নমুনাও যুক্ত করে দেওয়া হয়।
মুসা বলেন, ‘যেহেতু শাপলা প্রতীক পেতে আমাদের কোনো আইনগত জটিলতা নেই, সে কারণে আমরা ইসিকে আমাদের আগের অবস্থানই পুর্নব্যক্ত করেছি। এনসিপি শাপলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবে না।’
তবে এনসিপির কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন, দলটিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার ব্যাপারে মূল আপত্তি একটি গোয়েন্দা সংস্থার, যে কারণে নির্বাচন কমিশন চাইলেও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘শাপলা প্রতীক পেতে এনসিপির চিঠির সঠিক ব্যাখ্যাও ইসি দিতে পারেনি কমিশন। ইসি কোনো অদৃশ্য শক্তির চাপে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক বঞ্চিত করতে চাচ্ছে।’
একই সাথে দলটির নেতারা এটিও বলছেন, যদি শেষ পর্যন্ত যদি এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়া হয় তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দলগত অবস্থান রয়েছে তাদের।
এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তারা কোনো আইনি ব্যাখ্যা ছাড়া একটা সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে এটা ভাবার কোনো সুযোগ নাই। এটা কোনোভাবে হবে না।’
কী ভাবছে নির্বাচন কমিশন?
এনসিপির এমন অনড় অবস্থানের মধ্যেই সোমবার বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর বলা হয়, এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার ব্যাপারে ভাবছে নির্বাচন কমিশন।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনার ও ইসি কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তবে ইসি জানিয়েছে, নতুন প্রতীকের তালিকাসহ যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে শাপলা না থাকায় তারা এনসিপিকে প্রতীকটি দেওয়ার বিষয়ে নতুন করতে ভাবতে পারছেন না।
তবে কমিশন এটিও বলছে, শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচন কমিশন তাদের গেজেট সংশোধন করে তাহলেই কেবল শাপলা প্রতীক পাওয়ার একটি সুযোগ থাকবে এনসিপির।
কিন্তু সেটি কি নির্বাচন কমিশন করবে?
এই প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘এই নিয়ে আমাদের মধ্যে যদি নতুন করে কোনো আলোচনা হয় তখন বিবেচনা করা যাবে। তবে এখনো পর্যন্ত শাপলা নতুন করে গেজেটে যুক্ত করার ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি।’
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সোমবার নির্বাচন কমিশনের সামনে ‘বাংলাদেশ ড্রাইভার সমন্বয় পরিষদ জাতীয় ঐক্য পরিষদ’ ব্যানার নিয়ে একটি পক্ষ ইসির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
ওই ব্যানারে তারা শাপলা প্রতীক কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য বরাদ্দ না রাখায় ইসির প্রতি ধন্যবাদও জানাতে দেখা যায়।
ওই কর্মসূচি সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীরা বক্তব্য জানতে চাইলে সেখান থেকে সরে যান ওই ব্যক্তিরা।
শাপলা নিয়ে সংকট যে কারণে
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের দোসরা সেপ্টেম্বর রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।
গণ প্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রতীক দেওয়া হয় কেটলি।
নিবন্ধন পাওয়ার নয় মাসের মাথায় গত ১৭ই জুন নির্বাচন কমিশনের কাছে দলীয় প্রতীক পরিবর্তনের জন্য আবেদন জানায় নাগরিক ঐক্য।
তারা দলীয় প্রতীক ‘কেটলি’র পরিবর্তে শাপলা বা দোয়েল পাখি বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করে।
মূলত, নিবন্ধন পাওয়ার আগেই এনসিপি তাদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে শাপলাকে বাছাই করে। গত জুলাইয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা যে পথযাত্রা করেছে সেখানেও তারা শাপলা প্রতীক নিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল।
নিবন্ধন ও প্রতীক পাওয়ার পর আবার নতুন করে মান্নার শাপলা প্রতীক চেয়ে চিঠির বিষয়টিকেই সামনে আনছে নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের ব্যাখ্যা, এনসিপির আগেই শাপলা প্রতীক চেয়েছিল মান্নার নাগরিক ঐক্য। যে কারণে নতুন করে বিতর্ক এড়াতে শাপলাকে তারা প্রতীক তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।
এর আগে এনসিপি নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে মান্নার সাথে সাক্ষাতও করেন। পরে এনসিপির নিবন্ধন চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতীক প্রশ্নে জটিলতা তৈরি পর গত শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে মান্না লিখেন- ‘শাপলা প্রতীক যদি তাদের (এনসিপি) দিয়ে দেয়, কোনো মামলা করব না। কিন্তু প্রতিবাদ তো করব।’
সোমবার মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিলে ইসির প্রতি আমাদের আপত্তি থাকবে। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের রেসপেক্ট আছে। সেখান থেকে আমরা বলেছি আমরা কোনো মামলা করবো না বা আইনি লড়াইয়ে যাবো না।’
শাপলা প্রতীক নিয়ে এই জটিলতাকে একেবারেই স্বাভাবিকভাবে দেখছে না এনসিপি। তারা বলছে, এর পেছনে যে শক্তিটি কাজ করছে তারা নির্বাচন নিয়েই সংকট তৈরি করতে চাচ্ছে। যে কারণে ইসিও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘শাপলা প্রতীক দেওয়া না দেওয়া কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিষয় হতে পারে না। আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। ওনারা বলছেন শাপলা দিবেন না, এটার ব্যাখ্যাও তারা দেয়নি। কারণ এই নির্বাচন কমিশন এজেন্সি (গোয়েন্দা) সংস্থা দ্বারা প্রভাবিত।’
ছাত্রদের নতুন এই দলটি বলছে, শেষ পর্যন্ত শাপলা না পেলে নিবন্ধন না নিয়ে রাজপথের কর্মসূচিতে নামবেন তারা।
নিবন্ধন আটকে যেতে পারে?
প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে এনসিপির এখন যে টানাপোড়েন চলছে এমন অবস্থায় নতুন এই দলটির নিবন্ধন আটকে যাবে কিনা, এমন প্রশ্নও সামনে আসছে।
এই প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তাদের কেউ বলছেন, দ্রুতই আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধান করার সুযোগ আছে। আর তা না হলে বিষয়টি ঝুলেই থাকবে।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘এনসিপি চিঠি দিয়ে যদি গেজেটের ৫০টি প্রতীকের কোনোটি না নিতে চায় তখন দলটির নিবন্ধন ঝুলে যাবে। তবে এনসিপির সাথে আলোচনার মাধ্যমেও সংকটের সমাধান সম্ভব।’
টুলী এটিও বলছেন যে, যদি আলোচনায়ও প্রতীক ইস্যুতে সংকটের সমাধান না হয় তখন আদালতেও যাওয়ার সুযোগ আছে এনসিপির।
সূত্র: বিবিসি বাংলা